দেশের একমাত্র ওষুধ প্রস্তুতকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস্ কোম্পানি লিমিটেড- ইডিসিএল, যেখানে উচ্চ পর্যায় থেকে নিম্ন পদের কর্মীরাও নানা দুর্নীতি অনিয়মে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে বারবার।
সবশেষ নতুন নিয়োগ পাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী এমডি সামাদ মৃধার বিরুদ্ধেও অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। আর সে অভিযোগ তদন্তে কমিটিও গঠন করেছে মন্ত্রণালয়।
নতুন করে তার বিরুদ্ধে ‘নারী কেলেঙ্কারির’ অভিযোগ ওঠায় তাকে নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
গত ২২ জুন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার কয়েকটি নগ্ন ছবি ছড়িয়ে পড়ে, যে ছবিগুলোতে দেখা যায়, তিনি ভিডিও কলে কারও সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় আছেন।
‘স্যারের এসব ছবি আমাদের সবার কাছেই আছে, কিন্তু ভয়ে কউ কিছু বলছে না,’ বলেন এসেনসিয়াল ড্রাগসের এক কর্মী।
২২ জুন লন্ডন প্রবাসী এক সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট সাংবাদিক তার ফেসবুক পেজে একটি স্ট্যাটাস দেন। আর কমেন্টবক্সে তার টেলিগ্রাম চ্যানেলের লিংক শেয়ার করেন। যেখানে সামাদ মৃধার দুটি আপত্তিকর ছবি দেখা যায়। ওই ছবির বিষয়ে কথা বলেন তিনি।
‘দেখেন উনি (সামাদ মৃধা) যখন আমাকে কল করেন, তখন এসব ছবি নিয়ে আমি প্রশ্ন করি, এর উত্তরে তিনি এসব ছবি সত্য নয় বলে উড়িয়ে দেন। কিন্তু আমি এসব ছবি বিভিন্ন সফ্টওয়্যারে যাচাই করেছি, যেটি তাকে জানাই। এরপর তিনি চুপ থাকেন। আর এই ছবিতে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে তিনি ভিডিও কলে কারও সঙ্গে আপত্তিকর মুহূর্তে আছেন। রাষ্ট্রের এত গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে একজন ব্যক্তি কীভাবে এসব করতে পারেন!’ প্রশ্ন তোলেন তিনি।
নতুন করে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে এসেনসিয়াল ড্রাগসের দুর্নীতির বিষয়ে করা কমিটির সভাপতি স্বাস্থ্যসেবার অতিরিক্ত সচিব এটিএম সাইফুল ইসলাম বলেন, আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয় তদন্ত করতে একটি কমিটি করা হয়েছে। নতুন করে নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ নিয়ে আলাদা কমিটি করা হবে।
ইডিসিএলে কর্মরত এক কর্মচারী জানান, প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন নারী কর্মীর সঙ্গে সামাদ মৃধার সখ্য গড়ে উঠেছে। সেই সূত্রে তিনি নিয়মের বাইরে গিয়ে কয়েকজনকে প্রমোশনও দিয়েছেন।
নিয়োগের পর মাস খানেকের মধ্য এমডি সেকশনে আনা হয় এক সিনিয়র ক্লার্ককে। এর কিছুদিনের মধ্যই তাকে দুটি প্রমোশন দিয়ে জুনিয়র অফিসার বানিয়েছেন এমডি। ইডিসিলের অনেকেই তাকে এমডির প্রিয়ভাজন হিসেবে জানেন। আর এই নারীর কিছু গোপন ভিডিও এখন প্রতিষ্ঠানের সহকর্মীদের মুঠোফোনে এসেছে, যা নিয়ে চলছে কানাঘুষা।
এদিকে আরেক নারী উৎপাদন কর্মকর্তাকে একমাস আগে ব্যাকডেট দেখিয়ে প্রমোশন দেওয়া হয়। যা নিয়ে বিতর্ক চলছে ইডিসিএল ঢাকা প্ল্যান্টে।
এসব বিষয় জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান বলেন, এ বিষয় মন্ত্রণালয় কোনো অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো।
এদিকে ইডিসিএল এমডির এমন কেলেঙ্কারির বিষয়টি সামনে আসায় প্রতিষ্ঠানের অন্যান্যদের যৌন হয়রানি নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন ভুক্তভোগীরা।
‘২০১০ সাল থেকে আমি খুলনার কেএলপিতে কাজ করছি। ২০১৮ সালে একদিন মনির স্যার আমাকে ডেকে বলেন, তুমি আমার সাথে বেশি বেশি কথা বলবা। আর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলবা, তুমি কি চোখের ভাষা বোঝ না? আমি কি চাই বোঝ না? আমি সেদিন কাউকে কিছু বলিনি চাকরি হারানোর ভয়ে। কিন্তু দীর্ঘ পনের বছর চাকরি করার পর হঠাৎ করেই আমার চাকরিটা বিনা কারণে চলে গেল। আর এর পেছনে ওই মনির স্যারের হাত রয়েছে। আমার ওপর তিনি দীর্ঘদিনের ক্ষোভ মিটিয়েছেন।’ বলেন ভুক্তভোগী এক নারী, যিনি এপ্রিলে টারমিনেশন লেটার পান।
ভুক্তভোগী আরেক নারী জানান, ২০২২ সালে নারীঘটিত এক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মনিরকে বগুড়া প্লান্টে বদলি করা হয়। তবে চাকরি হারানোর ভয়ে কেউ তার অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেনি।
চাকরিচ্যুত আরেক নারী বলেন, ‘চাকরি যাওয়ার পাঁচদিন আগে উৎপাদন শ্রমিক আল আমীন (৩৬৮৭) আমাকে বলেন, যারা চাকরি বাঁচাতে চান তারা যেন টাকা নিয়ে তার সাথে যোগাযোগ করে। যারা টাকা দিতে পারবে তাদের নাম টারমিনেশন লিস্টে দেওয়া হবে না।’ তিনি ২০১১ সাল থেকে এ প্রতিষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘অতিরিক্ত জনবলের জন্য আমাদের চাকরি যায়নি। চাকরি গেছে মনির-কামালে গংদের রোষানলে পড়ে। এখানে অনেকের চাকরির বয়স ১০ থেকে ১৫ বছর। যারা নতুন জয়েন করেছেন তাদের চাকরি না গিয়ে আমাদেরটা গেল কেন?’
ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে ‘লাস্ট ইন ফার্স্ট আউট রুলস’ মানা হয়নি বলে তিনি দাবি করেন।
খুলনা প্ল্যান্টে প্যাকেজিং সেকশনে কর্মরত এক নারী কর্মী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) ড্রাইভার কামাল ও তার সহযোগী উৎপাদন শ্রমিক আল আমিনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে বলেন, ‘২০২২ সালে আমি এই প্ল্যান্টে জয়েন করি। তারপরই শুরু হয় ড্রাইভার কামাল ও তার সহযোগীদের দ্বারা যৌন নিপীড়ন, যার প্রতিকার আজও পাইনি। ড্রাইভার কামালের সহযোগী আল আমিন আমাকে টিজ করে বলে, তোমাকে হট লাগে, কেন আমদের সময় দাও না। একইভাবে আমাদের সেকশনে আরও ৫-৬ জনকে নানাভাবে ড্রাইভার কামালের পক্ষ থেকে অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়া হতো। বলা হতো, ড্রাইভার কামালকে সময় দিলে চাকরি নিরাপদ থাকবে।’
পিকনিকে আর্থিক অনিয়ম:
ইডিসিএলের এক প্ল্যান্টের পিকনিকে অন্য প্ল্যান্টের কর্মীদের যাওয়ার অনুমতি নেই। কিন্তু মধুপুর প্ল্যান্টের পিকনিকে ড্রাইভার কামালের গাড়ি দিয়ে খুলনা প্ল্যান্টের তিন নারী কর্মী কর্মকর্তা (প্রশাসন) শাপলা খাতুন (৬২৮), কনিষ্ঠ কর্মকর্তা (প্রশাসন) অনন্যা ইউসুফ (২৩১৬), সহকারী কর্মকর্তা (প্রশাসন) সোনিয়া শারমিন (৩৭০৪) ও তাদের পরিবারের সদস্যদেরও নিয়ে যাওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানের এমডি বলেন, উপস্থাপনা করতেই তাদেরকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেন তিনি।
এদিকে খুলনার সরকারি প্রতিষ্ঠান খুলনা এসেন্সিয়াল ল্যাটেক্স প্লান্ট (কেইএলপি)-তে ২০২৫ সালের বার্ষিক বনভোজন উপলক্ষে ৩৭ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭০ টাকার বাজেট বরাদ্দ হলেও, বাস্তবে তার সিংহভাগই দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ হয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে। বনভোজনের সমস্ত খরচ এককভাবে তোলা হয় উপ-প্রশাসনিক কর্মকর্তা শাপলা খাতুনের নামে। আরও বিস্ময়ের বিষয় হলো—সব ভাউচার এবং খরচপত্র এক ব্যক্তির হাতের লেখা, যেখানে মাছ, মাংস, ফলমূল থেকে শুরু করে পোশাক কেনা পর্যন্ত একই হাতের লেখায় প্রস্তুতকৃত মেমো পাওয়া গেছে।
প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুস সামাদ মৃধা প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নিলেও তার সঙ্গে বিশেষ অতিথি ছিলেন আলোচিত এক মডেল। আপ্যায়নের নামে ৪০ কেজি খাসির কলিজা, ৪০ কেজি আপেলের জুস, আধা মন আঙ্গুর এবং ২৬৪ কেজি মাছ— যার মধ্যে ৬০ কেজি রূপচাঁদা, ১১৫ কেজি চিংড়ি, ৩৬ কেজি বোয়াল ইত্যাদির বিল দেখানো হয়। মাছের জন্যই ব্যয় ধরা হয় ৪ লাখ ১৬ হাজার ৫০০ টাকা। অথচ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মাছ খেতেই পাননি। ১৬০ কেজি আপেল বিতরণ করা হলেও ১৫০ কেজি কমলা শুধু বিলেই ছিল।
৪ হাজার পিস ২ টাকার চকলেটের বিল করা হয়েছে ১০ টাকা দরে। সোনালি মুরগির রোস্ট থাকলেও ২০০ কেজি ব্রয়লার মুরগির বিল দেখানো হয় ৪২ হাজার টাকার। ৮৮১ জনের বনভোজনে ৩০০ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ও ১৫০ জন ক্যাটারিং—প্রত্যেককে উপহার দেওয়া হয় ভিআইপি বেডশিট, যার দাম দেখানো হয়েছে ১,৭০০ থেকে ৩,৭০০ টাকা পর্যন্ত। অথচ প্রকৃত মূল্য ছিল ৪৫০–৮৫০ টাকার মধ্যে। ৫০০ এমএলের পানির বোতলের বদলে ২৫০ এমএল সরবরাহ করে ৫,২০০ বোতলের বিল করা হয়। সিগারেটের বিল দেখানো হয়েছে ৩ লাখ ৫ হাজার টাকা— যার সিংহভাগ উঠেছে সিবিএ নেতা কামাল ও তার সহযোগী আল-আমিনের পকেটে।
আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে হিসাব বিভাগের প্রধান কাজী তানজিমা তাবাচ্ছুম (২৩৪৯) বলেন, ‘যারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে, তারা মিথ্যা বলছে। সাধারণত চাকরিচ্যুত ব্যক্তিরা ঈমান হারিয়ে ফেলেন, তাই মিথ্যা কথা বলে থাকে। আমি মাত্র হজ করে ফিরেছি ২০ জুন। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ, সেগুলো সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা।’
ইডিসিএল আর্থিক অনিয়ম এতটাই তুঙ্গে যে এখানে একই পরিবারের ডজন ডজন লোক কাজ করছেন বিশেষ সুপারিশে, তার বড় উদাহরণ হাসান ইমাম। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তার পরিবার আত্মীয়-অনাত্মীয় মিলে এখানে প্রায় ৫০ জন লোক কাজ করে। এর মধ্যে তার আপন তিন বোন ঢাকা, গোপালগঞ্জ ও খুলনা প্ল্যান্টে কর্মরত। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি নিছক ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দেন।